ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস কি?
ইলেক্ট্রোলাইট হচ্ছে এক ধরনের খনিজ বা বৈদ্যুতিক চার্জ-যুক্ত পদার্থ। এগুলো রক্ত, টিস্যু, অঙ্গ এবং অন্যান্য শারীরিক তরলগুলোতে পাওয়া যায়। সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ফসফেট এবং ম্যাগনেসিয়াম সবই ইলেক্ট্রোলাইট।
চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, ইলেক্ট্রোলাইট শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এগুলো শরীরে পানির পরিমাণের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
হঠান ডায়রিয়া এবং বমি হওয়ার মতো সমস্যা হয়, শরীরে পানির অভাব দেখা দেয়। ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্তি পেতে, চিকিৎসকরা ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় পানের পরামর্শ দেন।
স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সালেহউদ্দিন মাহমুদ তুষার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”সারা পৃথিবীতে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস পাওয়া যায়। এটা স্পোর্টস ড্রিংক হিসেবে বেশি প্রচলিত। আমাদের দেশে আগে এটা ছিল না। তবে এখন এটা পাওয়া যায়।”
এই চিকিৎসক বলছেন, আমাদের শরীরে যখন অনেক ঘাম হয় তখন যে লবন বের হয়ে যায়, এর ঘাটতি পূরণের উপাদানগুলো রয়েছে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকে। যারা ওয়ার্ক আউট করে, বা খেলাধুলা করে তাদের জন্য এটা প্রয়োজনীয়।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, মানুষের শরীরের পিএইচ স্তর বজায় রাখতে এবং কোষের ভেতরে এবং বাইরে পুষ্টি সরবরাহ করতে সাহায্য করে ইলেক্ট্রোলাইট। এটি পেশী, স্নায়ু এবং অন্যান্য অঙ্গকে সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।
পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক উপকারী হতে পারে। যেমন, যারা দীর্ঘমেয়াদী ব্যায়াম, শারীরিক পরিশ্রম করে বা অতিরিক্ত ঘাম কিংবা ডায়রিয়া জনিত কোন কারণে শরীর আক্রান্ত হয় তখন এটি কাজে দেয়।
অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশের বাজারে পাঁচ ধরনের ইলেক্ট্রোলাইট পানীয় বিক্রির অভিযোগে কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরই প্রশ্ন উঠেছে, অনুমতি ছাড়াই কিভাবে প্রায় তিন বছর ধরে বাজারে বেচাকেনা চলছে অনুমোদনহীন ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকসগুলো?
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কোন পণ্য উৎপাদনের লাইসেন্স পাওয়ার পর উৎপাদন শুরু করবে। কিন্তু এসব কোম্পানি কোন অনুমতি ছাড়াই বাজারজাত করা শুরু করেছে। একই সাথে ওই সব পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারণাও করছে।
অসত্য তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা ও অনুমোদন ছাড়া পণ্য বিক্রি করায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে গত ১৪ মে মামলা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসান ।
ওই ইলেক্ট্রোলাইট পানীয়গুলো হল- একমি ও এসএমসি কোম্পানির এসএমসি প্লাস, প্রাণের অ্যাক্টিভ, ব্রুভানা বেভারেজ লিমিটেডের ব্রুভানা, দেশবন্ধু ও আগামী কোম্পানির রিচার্জ এবং আকিজের টারবো।
শুনানি শেষে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত ও পাঁচ শিল্প গোষ্ঠীর মালিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
খাদ্য পরিদর্শক মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এগুলোর গায়ে যা লেখা আছে তাতে বোঝা যায় না এটা পানীয় নাকি ওষুধ জাতীয় পণ্য। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো বিএসটিআই কিংবা ওষুধ প্রশাসন কারো কাছ থেকেই অনুমোদন না নিয়েই এসব পণ্য বাজারজাত করেছে। যাতে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও রয়েছে”।
তবে, প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায় নি।
তাহলে অনুমোদন ছাড়াই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত কিভাবে হলে এ নিয়ে স্পষ্ট কোন উত্তর নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেও।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই ইলেক্ট্রোলাইট পণ্যের নির্দিষ্ট কোন মানদণ্ড না থাকার কারণে আমরা অনুমতি নিতে পারি নি। এজন্য গত জানুয়ারি মাসে আমরা বিএসটিআই’র কাছে একটা চিঠি দিয়েছিলাম যে পণ্যটির মান প্রণয়নের জন্য।”
অনুমোদনের বিষয়ে বিএসটিআই’র উপপরিচালক মো. রিয়াজুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস বাধ্যতামূলক পণ্যের আওতায় পড়ে না। এ কারণে আমরা অনুমোদন দিতে পারি না”।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. খান আবুল কালাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইলেক্ট্রোলাইট সলিউশনগুলো যারা বাংলাদেশে বানাবে এবং বাজারজাত করবে, এতে রিয়েলি ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা কেমন থাকবে সেটা ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে তারপর ছাড়পত্র দেয়া প্রয়োজন”।
কেন এবং কিভাবে অনুমোদন ছাড়া বাজারে আসলো এই পণ্যগুলো সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
অনুমোদন নিয়ে যে প্রশ্ন
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন বা বিএসটিআই পণ্যের গুণগত মান ও ভোক্তার জন্য উপযোগী খাদ্যদ্রব্য, কৃষিপণ্য, পাটবস্ত্র, রাসায়নিক পদার্থ এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির পণ্য সামগ্রীর তদারকি ও লাইসেন্স প্রদান করে থাকে। তাই পণ্য বাজারজাত করার আগে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই হচ্ছে বিএসটিআই-এর অনুমোদন নেওয়া।
বাজারজাত করা পণ্যের অনুমোদনের জন্য বাধ্যতামূলক পণ্য অথবা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পণ্য উভয় ক্ষেত্রে একজন উৎপাদনকারী, মোড়কজাতকারী অথবা আমদানিকারককে বিএসটিআই সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।
ওই পাঁচ কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতের এই সিদ্ধান্তের পর ওই কোম্পানিগুলো দাবি করেছে, এ ধরনের পানীয়র অনুমতি নিতে তারা চেষ্টা করেও পারেন নি।
সবার আগে বাজারে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক আনে এসএমসি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এসএমসি জেনেশুনে কোন ভুল করেনি। বিএসটিআইয়ে যে পণ্যের অনুমোদনের অপশনই নাই, সেখানে আমরা কিভাবে অনুমোদন নিবো”?
তিনি বলছেন, “আমরা যখন অনুমোদনের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। তখন তারা আমাদের বলে আপনারা চালু করেন, যখন এই ক্যাটাগরির মানদণ্ড তৈরি করা হবে, তখন তারা অনুমোদন দেবে”।
একই ভাবে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক বাংলাদেশের বাজারে বাজারজাত করেছে প্রাণ গ্রুপ। অনুমোদন ছাড়া আদালত ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকের যে পাঁচটি কোম্পানির মালিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়েছে তার একটি প্রাণ গ্রুপ।
প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে সব পণ্যের বিএসটিআই’র মানদণ্ড বা নীতিমালা নেই তা বাজারজাত করতে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। যেগুলোর মান নির্ধারণ করা আছে, সেগুলো বাজারজাত করতে অনুমোদন লাগে, সেগুলো আমরা অনুমোদন নেই”।
তিনি বলছিলেন, মানদণ্ড না থাকার কারণে এটির অনুমোদনের প্রয়োজন হয়নি তাদের।
বিএসটিআই’র উপ-পরিচালক মি. হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেহেতু এটা আমাদের দেশে এই পণ্যটির স্ট্যান্ডার্ডই নাই সে কারণে, সে কারণে আমরা লাইসেন্স দিতে পারছি না। তবে আমাদের চিন্তা রয়েছে শিগগিরই একটা স্ট্যান্ডার্ড আমরা তৈরি করবো”।
খাদ্য কর্তৃপক্ষের মামলার কারণ কী?
বিএসটিআই বলছে, এই পণ্যটি বাজারে নতুন হওয়ার কারণে তারা এখনো এই পণ্যটির মানদণ্ড নির্ধারণ করেনি। তবে শিগগিরই তারা এটির মান নির্ধারণে কাজ শুরুর কথা জানান।
এমন অবস্থায় অনুমোদন ছাড়া পণ্য বাজারজাত করায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিদর্শক কামরুল হাসান গত ১৪ মে মামলা করেন বাজারে ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংক আনা সাত কোম্পানির বিরুদ্ধে।
শুনানি শেষে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত ওই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
খাদ্য পরিদর্শক মি. হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওষুধ প্রশাসনও বলতে পারে না এগুলো ওষুধ না ড্রিংক। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এগুলোর বিজ্ঞাপনও চলছে । নিরাপদ খাদ্য আইন অনুযায়ী যা অপরাধ। আমরা বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে বললেও তা কোম্পানিগুলো শোনেনি”।
তবে কোম্পানিগুলো বলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের পানীয় রয়েছে। এ ধরনের পানীয়র ক্ষেত্রে ড্রাগের কোন অনুমোদন লাগে না।
এমন অবস্থায় আদালত ঐ কোম্পানিগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিতে বললেও, পণ্যটি বাজারে থাকা না থাকা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেয় নি। যে কারণে এখনো বাজারে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. মৃধা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এটি নিয়ে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে, আদালত এখনো বলেনি এই পণ্য বিক্রি করা যাবে না। তাই এখনো এটি বাজারে বিক্রি চলছে। পরবর্তীতে আদালত যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা পালন করবো।”